প্রাচীনকালে শারীরিক শিক্ষা বলতে শরীর সম্বন্ধীয় শিক্ষাকে বোঝানো হতো। আধুনিককালে এ ধারণা ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। শরীর সম্বন্ধীয় শিক্ষা বা শারীরিক কসরতকে শারীরিক শিক্ষা নয় শরীরচর্চা বলে। শারীরিক শিক্ষা শুধু শরীর নিয়েই আলোচনা করে না, এর সাথে মানসিক বিকাশ ও সামাজিক গুণাবলি কীভাবে অর্জিত হয় সে ব্যাপারেও সহায়তা করে। শরীর ভালো না থাকলে মন ভালো থাকে না, কাজে মন বসে না, তাই দেহ ও মনের সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ। 'সুস্থ দেহে সুন্দর মন' প্রাচীন এই প্রবাদটি সর্বযুগে সর্বকালে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে শারীরিক উন্নয়ন, মানসিক বিকাশ ও সামাজিক গুণাবলি অর্জনই হলো শারীরিক শিক্ষা। শারীরিক শিক্ষা কর্মসূচি নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে সুস্থ জীবন লাভ করা যায়। একজন শিক্ষার্থী শারীরিক শিক্ষা লাভ করে সুস্থ দেহে সুন্দর মনের অধিকারী হয়ে সমাজে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে।
এ অধ্যায় শেষে আমরা-
ক. নেতৃত্ব বিকাশ
খ. ব্যক্তিত্ব অর্জন
গ. চরিত্র গঠন
ঘ. সামাজিক বিকাশ
শারীরিক শিক্ষা সম্পর্কে কিছু বলতে বা সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গেলে প্রথমেই শিক্ষা সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। শারীরিক শিক্ষা শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ। শারীরিক শিক্ষা ছাড়া শিক্ষা অসম্পূর্ণ। শিক্ষা শব্দটির ব্যাখ্যা প্রদান করলে শারীরিক শিক্ষা কী তা বোঝা সহজ হবে। শিক্ষা সম্পর্কে বিভিন্ন পণ্ডিত ব্যক্তি নানাভাবে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন যা বিভিন্ন অবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট। শিক্ষা শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ নয়, ব্যক্তির শারীরিক, সামাজিক, আবেগিক ও অন্যান্য দিকেরও সুষম বিকাশ সাধন করে। শিক্ষা ব্যক্তিজীবনের কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়েই ঘটে না, শিক্ষা জীবনব্যাপী বিস্তৃত। শিক্ষা শুধুমাত্র মাদ্রাসার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, শিক্ষা অর্জিত হয় পরিবারে, সমাজে, খেলার মাঠে এবং সর্বত্র।
শিক্ষা সম্পর্কে কয়েকটি প্রাসঙ্গিক সংজ্ঞা-
শিক্ষা ব্যক্তির সর্বোচ্চ সম্ভাব্য শারীরিক ও আত্মিক সৌন্দর্য ও উৎকর্ষ সাধন করে। (Education helps in the body and soul of the pupil all the beauty and all the perfection he is capable of) Plato. শিক্ষা হলো সুস্থ শরীরে সুস্থ মন তৈরি (Education is the creation of sound mind in a sound body)। শরীর, মন ও আত্মার সর্বোচ্চ বিকাশ সাধনই হলো শিক্ষা ।শারীরিক শিক্ষা ও শিক্ষার সম্পর্ক সম্বন্ধে সি. এ. বুচার (C. A. Bucher) বলেছেন-“শারীরিক শিক্ষা, শিক্ষার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শারীরিক শিক্ষা হলো সুনির্দিষ্ট শারীরিক কাজকর্মের মাধ্যমে শারীরিক, মানসিক, আবেগিক এবং সামাজিক দিক দিয়ে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা।” এ উক্তি থেকে বোঝা যায় শিক্ষা ও শারীরিক শিক্ষা একে অপরের পরিপূরক। ডি.কে. ম্যাথিউস বলেছেন- শারীরিক কার্যকলাপের দ্বারা অর্জিত শিক্ষাই শারীরিক শিক্ষা হপ শিথ ও ক্লিফটন বলেছেন- বিজ্ঞানসম্মত ও কৌশলগত অঙ্গসঞ্চালনের নাম শারীরিক শিক্ষা। জে. বি. ন্যাশ বলেছেন- “শারীরিক শিক্ষা গোটা শিক্ষার এমন একদিক যা মাংসপেশির সঠিক সঞ্চালন ও এর প্রতিক্রিয়ার ফল হিসেবে ব্যক্তির দেহের ও স্বভাবের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধন করে।” উল্লিখিত উক্তিগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় শারীরিক শিক্ষার মূল কথা হলো- দেহ ও মনের সার্বিক উন্নতির লক্ষ্যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সুষম উন্নয়ন, মানসিক বিকাশ সাধন, সামাজিক গুণাবলি অর্জন ও খেলাধুলার মাধ্যমে চিত্তবিনোদন।
কাজ-১: | শারীরিক শিক্ষার সংজ্ঞাগুলো পোস্টার পেপারে লিখে দেয়ালে লাগিয়ে রাখ |
---|
সাধারণভাবে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এই ধারণার মধ্যে আমরা কোনো পার্থক্য করি না। অনেক সময় একের জায়গায় অন্যটিকে ব্যবহার করি। কিন্তু এই দুই ধারণা সমার্থক নয় । এদের মধ্যে পার্থক্য আছে। লক্ষ্য হলো চূড়ান্ত গন্তব্যস্থল আর উদ্দেশ্য হলো সেই গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর সংক্ষিপ্ত ও নির্দিষ্ট পদক্ষেপসমূহ। যেমন- সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠার ক্ষেত্রে লক্ষ্য হলো ছাদ, আর সিঁড়ির এক একটি ধাপ হলো উদ্দেশ্য। লক্ষ্যের অস্তিত্ব মানুষের কল্পনায়, তার রূপায়ণ সম্ভব হয় না। কিন্তু উদ্দেশ্য হলো বাস্তব। মানুষ উদ্দেশ্য অর্জন করতে পারে এমনকি তার পরিমাপও সম্ভব। শারীরিক শিক্ষাবিদগণ শারীরিক শিক্ষার লক্ষ্যে পৌছানোর জন্য বেশ কয়েকটি অন্তবর্তী পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেছেন। বিভিন্ন শারীরিক শিক্ষাবিদগণ শারীরিক শিক্ষার লক্ষ্য হিসেবে নিম্নলিখিত মত ব্যক্ত করেছেন: উইলিয়ামস্-এর মতে “শারীরিক শিক্ষার লক্ষ্য হলো ব্যক্তির শারীরিক, সামাজিক ও অন্যান্য দিকের সুষম উন্নতি ঘটিয়ে ব্যক্তিসত্তার সর্বাঙ্গীণ বিকাশ সাধনের চেষ্টা করা”। বুক ওয়াল্টার বলেছেন- “শারীরিক শিক্ষার লক্ষ্য হলো শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক দিকসমূহের সুসমন্বিত বিকাশ সাধন”। এই বিকাশ সাধনের উপায় হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও নিয়মনীতি অনুসারে পরিচালিত খেলাধুলা, ছন্দময় ব্যায়াম এবং জিমন্যাস্টিকস্ ইত্যাদি ক্রিয়াকর্মে অংশগ্রহণ । এগুলোই শারীরিক শিক্ষার উদ্দেশ্য হিসেবে স্বীকৃত। বিশেষজ্ঞগণ কিছু উদ্দেশ্য সম্পর্কে একমত হলেও কিছু উদ্দেশ্য নিয়ে মতের ভিন্নতাও প্রকাশ করেছেন। কয়েকটি প্রাথমিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতামত থেকে শারীরিক শিক্ষার উদ্দেশ্যগুলো চিহ্নিত করা সম্ভব। বিভিন্ন চিন্তাবিদদের মতামত বিবেচনা করে শারীরিক শিক্ষার উদ্দেশ্যকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে যথা-
১. শারীরিক সুস্থতা অর্জন ।
২. মানসিক বিকাশ সাধন ।
৩. চারিত্রিক গুণাবলি অর্জন ।
৪. সামাজিক গুণাবলি অর্জন।
১. শারীরিক সুস্থতা অর্জন
ক. খেলাধুলার নিয়মকানুন মেনে ভালো করে খেলতে পারা।
খ. কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হাসিল করা।
গ. স্নায়ু ও মাংসপেশির সমন্বয় সাধনে কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
ঘ. দেহ ও মনের সুষম উন্নতি করা।
ঙ. সুস্বাস্থ্যের মাধ্যমে শারীরিক সক্ষমতা অর্জন করা।
চ. সহিষ্ণুতা ও আত্মবিশ্বাস অর্জন করা।
২. মানসিক বিকাশ সাধন
ক. উপস্থিত চিন্তাধারার বিকাশ সাধন ।
খ. নৈতিকতা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন।
গ. সেবা ও আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হওয়া।
ঘ. বিভিন্ন দলের মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ ও প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব গড়ে উঠা।
৩. চারিত্রিক গুণাবলি অর্জন
ক. আনুগত্যবোধ ও নৈতিকতা বৃদ্ধি পাওয়া।
খ. খেলাধুলার মাধ্যমে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হওয়া।
গ. খেলোয়াড়ি ও বন্ধুত্বসুলভ মনোভাব গড়ে উঠা।
ঘ. প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মনোভাব গড়ে উঠা।
ঙ. আত্মসংযমী হওয়া ও আবেগ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করা।
৪. সামাজিক গুণাবলি অর্জন
ক. নেতৃত্বদানের সক্ষমতা অর্জন ও সামাজিক গুণাবলি অর্জন করা।
খ. বিনোদনের সাথে অবসর সময় কাটানোর উপায় জানা।
গ. বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করা।
ঘ. সকলের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ ও সেবামূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা ।
শারীরিক শিক্ষাবিদদের মতামত থেকে এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, শারীরিক শিক্ষার উদ্দেশ্য সাধারণ শিক্ষার মতোই ব্যক্তিসত্তার সর্বোচ্চ ও সুষম বিকাশ সাধন করে থাকে এবং পরিকল্পিতভাবে খেলাধুলা পারদর্শিতা অর্জনে সাহায্য করে।
কাজ ১: | শারীরিক শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের মধ্যে পার্থক্যগুলো পোস্টার পেপারে লিখে দেয়ালে লাগাও । |
---|---|
কাজ ২: | সামাজিক উদ্দেশ্যগুলো দ্বারা কী অর্জন করা যায় দলে বিভক্ত হয়ে আলোচনা কর। |
কাজ ৩: |
শারীরিক সুস্থতা অর্জনের উদ্দেশ্যগুলো বোর্ডে লিখে দেখাও। |
শারীরিক শিক্ষা দেহ ও মনের সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নয়ন সাধন করে। শারীরিক শিক্ষা ছাড়া শিক্ষার পূর্ণতা আসে না। যে সব গুণ থাকলে দেশের প্রতিটি নাগরিক সুস্থ, সবল ও দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন হয়ে গড়ে উঠে এবং নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হয়, শারীরিক শিক্ষা সেই গুণাবলি অর্জনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। মানুষ সমাজে স্বীকৃতি পেতে চায়। এই স্বীকৃতির মাধ্যমেই তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে। তাই নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্ব গঠনেও শারীরিক শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। আমাদের দেহ কতকগুলো অঙ্গের সমষ্টি। আবার প্রত্যেকটি অঙ্গ নানাপ্রকার মাংসপেশি, হাড়, শিরা, ধমনি ইত্যাদি নিয়ে গঠিত। দেহকে ঠিক রাখার জন্য সব সময়ই দেহের মধ্যে কতকগুলো প্রক্রিয়া কাজ করছে। এই প্রক্রিয়াগুলো সুষ্ঠুভাবে চলার জন্য প্রয়োজন শারীরিক সুস্থতা। উপযুক্ত খাবার, অঙ্গ সঞ্চালন, বিশ্রাম ও ঘুম এইগুলির অভাবে শরীর সঠিকভাবে বৃদ্ধি পায় না ও সুস্থ থাকে না। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা দৈহিক ও মানসিক বিকাশের উপর সমান গুরুত্ব আরোপ করছে।
মাদ্রাসায় শারীরিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাগুলো ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করা হলো-
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো সামাজিক প্রতিষ্ঠান। তাই সমাজ সংরক্ষণ, সমাজ সংস্কার ও ইতিবাচক সামাজিক পরিবর্তনের কাজে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমাজ ও দেশের কাছে দায়বদ্ধ। দেশের মানবসম্পদকে সঠিকভাবে বিকশিত করা এবং আজকের শিশুকে আগামী দিনের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর ন্যস্ত। এ ব্যাপারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাজ মূলত দ্বিমুখী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রথম কাজ হলো শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত বিকাশ সাধন করা। এর মধ্যে শিক্ষার্থীর শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক দিক অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয় কাজ হলো শিক্ষার্থীর জৈবিকসত্তাকে সামাজিক সত্তায় রূপান্তরিত করা। এর মধ্যে শিশুর চারিত্রিক ও মূল্যবোধের উন্নতি এবং সামাজিক বিকাশ অন্তর্ভুক্ত। এই কাজের মধ্যে প্রথমটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রত্যক্ষ কাজ এবং দ্বিতীয়টি তার পরোক্ষ দায়িত্ব। শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীণ বিকাশের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক শিক্ষার প্রয়োজন হয়। মাসলো-এর মতে শিক্ষার্থীর এই প্রয়োজন তিনটি স্তরে বিন্যস্ত। যেমন-
১. শারীরিক ও শারীরবৃত্তীয় প্রয়োজন (Biological need )
২. মানসিক ও আত্মিক পরিপূর্ণতার প্রয়োজন (Psychological need)
৩. সামাজিক প্রয়োজন (Social need)
১. শারীরিক ও শারীরবৃত্তীয় প্রয়োজন : শিক্ষার্থীর শারীরিক ও শারীরবৃত্তীয় প্রয়োজন পূরণে শারীরিক শিক্ষা প্রত্যক্ষ কাজ করে। এ ব্যাপারে শারীরিক শিক্ষার ভূমিকা হলো-
ক. শারীরিক শিক্ষা শিক্ষার্থীর গতিশীল কাজের জৈবিক প্রয়োজন পূরণ করে ।
খ. শিক্ষার্থীর দৈহিক গঠন সুন্দর ও মজবুত করে।
গ. শিক্ষার্থীর শারীরিক সক্ষমতা ও কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
ঘ. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় ৷
ঙ. শিক্ষার্থী খেলাধুলার কৌশল শেখার মাধ্যমে খেলাধুলায় পারদর্শিতা অর্জন করে।
চ. শারীরিক শিক্ষা সুস্থ মনের জন্য সুস্থ দেহ গড়ে তোলে।
২. মানসিক ও আত্মিক পরিপূর্ণতা প্রয়োজন
ক. শিশুর মানসিক ও বুদ্ধিমত্তার ভিত গড়ে তোলে।
খ. পড়াশোনার একঘেয়েমিতা দূর করে।
গ. শিক্ষার্থীর চারিত্রিক গুণাবলির বিকাশ ঘটায় ।
ঘ. আত্মসচেতনতা, আত্মনির্ভরতা, আত্মোপলব্ধি ও আত্মসম্মান বাড়িয়ে তোলে।
ঙ. পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলতে সাহায্য করে।
চ. শিক্ষার্থীর মনে সৃজনশীলতার অনুভূতি জাগ্রত করে।
ছ. ক্ষতিকর নেশা থেকে দূরে রাখে।
জ. চিত্তবিনোদন ও অবসর সময় কাটানোর উপায় নির্বাচনে সাহায্য করে।
৩. সামাজিক প্রয়োজন
ক. প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তোলে।
খ. খেলাধুলায় সামাজিক সম্পর্কের প্রতিফলন ঘটে ও মানসিক গুণ অর্জনে সহায়তা করে।
গ. শারীরিক শিক্ষা নেতৃত্বদানের ক্ষমতার বিকাশ ঘটায় ৷
ঘ. দেশ ও সমাজের সংস্কৃতির সাথে পরিচয় ঘটায় ।
ঙ. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সৌভ্রাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলে ।
চ. শিক্ষার্থীর উদার মানসিকতা ও সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে।
কাজ -১ : |
শারীরিক ও শারীরবৃত্তীয় প্রয়োজনগুলো কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে আলোচনা কর। |
কাজ- ২ : |
মানসিক ও আত্মিক প্রয়োজনীয়তাগুলো ৩টি দলে ভাগ হয়ে প্রত্যেক দল ২টি করে প্রয়োজনীয়তা উপস্থাপন কর। |
কাজ- ৩ : |
সামাজিক প্রয়োজনগুলো বোর্ডে লেখ । |
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খেলাধুলা, ব্যায়াম, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ও বিনোদনমূলক যে সমস্ত কর্মসূচি পরিলক্ষিত হয় তাকে শারীরিক শিক্ষার কর্মসূচি বলে। একজন শারীরিক শিক্ষক যে সমস্ত ক্রীড়াকর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন তাই শারীরিক শিক্ষার কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত।
শারীরিক শিক্ষার কর্মসূচিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়-
১. অত্যাবশ্যকীয় ক্রীড়া কর্মসূচি (Compulsory Sports Programme)
২. অন্তঃক্রীড়াসূচি (Intramural Sports)
৩. আন্তঃক্রীড়াসূচি (Extramural Sports)
১. অত্যাবশ্যকীয় ক্রীড়া কর্মসূচি (Compulsory Sports Programme) :
একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে সরকারি নির্দেশাবলি, শারীরিক শিক্ষা বিষয়ক ক্লাস, প্রতিযোগিতা, প্রাত্যহিক সমাবেশ ও স্থানীয় নির্দেশনা ইত্যাদি সবই অত্যাবশ্যকীয় ক্রীড়াকর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত। এই কর্মসূচিগুলো একজন শারীরিক শিক্ষকের অবশ্যই পালন করতে হয়। সরকারি নির্দেশনাবলি বলতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক জারিকৃত শারীরিক শিক্ষা বিষয়ক যে সমস্ত নির্দেশনা, যেমন- প্রাত্যহিক সমাবেশ করতে হবে, প্রতিদিন/ সপ্তাহে ৩টি ক্লাস নিতে হবে, আন্তঃমাদ্রাসা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে হবে, জাতীয় দিবসগুলোতে খেলাধুলা করাতে হবে ইত্যাদিকে বোঝায়। স্থানীয় নির্দেশনা বলতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নিয়মকানুনসমূহকে বুঝিয়ে থাকে যেমন- মাদ্রাসা ক্যাম্পাস পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, বার্ষিক ক্রীড়ায় অংশগ্রহণ করা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগদান করা, দৈহিক উন্নতির পরিমাপের পরীক্ষা নেওয়া, টিফিন প্রোগ্রাম পরিচালিত করা ইত্যাদি।
২. অন্তঃক্রীড়াসূচি (Intramural Sports) :
ইন্ট্রামুরাল একটি ল্যাটিন শব্দ। Intra অর্থ ভিতরে এবং Mural অর্থ দেয়াল। তাহলে সম্পূর্ণ অর্থ দাঁড়ায় দেয়ালের ভিতরে অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের চারি দেয়ালের মধ্যে বা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা আকারে যে সমস্ত খেলাধুলা হয় তাকে ইন্ট্রামুরাল স্পোর্টস বলা হয়। যেমন- বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, নবম শ্রেণি বনাম দশম শ্রেণি ক্রিকেট ম্যাচ, অথবা ষষ্ঠ শ্রেণি ক ও খ শাখার মধ্যে প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। যদি হাউজ থাকে তাহলে হাউজে হাউজে যে প্রতিযোগিতা হয় তাও এর আওতায় পড়ে। এ ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষক বা বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে বা ১ম বর্ষ বনাম ২য় বর্ষের মধ্যে যে সমস্ত প্রতিযোগিতা হয় সেগুলোও ইন্ট্রামুরাল স্পোর্টসের অন্তর্গত। অর্থাৎ নিজেদের মধ্যে যে খেলাধুলা বা প্রতিযোগিতা হয় তাকে ইন্ট্রামুরাল স্পোর্টস বলে।
৩. আন্তঃক্রীড়াসূচি (Extramural Sports) :
Extra অর্থ বাইরে, Mural অর্থ দেয়াল অর্থাৎ দেয়ালের বাইরে যে সমস্ত খেলাধুলা হয় তাকে আন্তঃক্রীড়াসূচি (Extramural Sports) বলা হয়। যে সমস্ত খেলাধুলা বা প্রতিযোগিতা এক মাদ্রাসার সাথে অন্য মাদ্রাসা, এক কলেজের সাথে অন্য কলেজের মধ্যে হয় তাকে আন্তঃক্রীড়া প্রতিযোগিতা বলা হয়। যেমন- আন্তঃমাদ্রাসা, আন্তঃকলেজ, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয়, আন্তঃক্লাব ইত্যাদি প্রতিযোগিতা বোঝায়। এ সমস্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিজ দলের যোগ্যতা যাচাই করা যায়। এ ধরনের প্রতিযোগিতায় বিভিন্নমানের খেলোয়াড়রা অংশগ্রহণ করে। ফলে ভালো খেলোয়াড়ের সাহচর্যে এসে তাদের আচার-ব্যবহার, উন্নতমানের কৌশল ইত্যাদি থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে। এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দলগত সমঝোতা ও উৎকর্ষ বাড়ে, প্রতিযোগিতার মনোভাব ও সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পায় ৷
কাজ-১ : | শারীরিক শিক্ষা কর্মসূচিগুলো দলগতভাবে আলোচনা কর। |
---|---|
কাজ-২ : | অত্যাবশ্যকীয় ক্রীড়া কর্মসূচি বলতে কী বোঝ শ্রেণিকক্ষের বোর্ডে লিখে দেখাও । |
কাজ-৩ : | ইন্ট্রামুরাল ও এক্সট্রামুরাল স্পোর্টস এর পার্থক্যগুলো পোস্টার পেপারে লিখে শ্রেণিকক্ষের বোর্ডে টাঙ্গিয়ে দাও। |
সাধারণ শিক্ষার সাথে শারীরিক শিক্ষা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। শিক্ষাকে পূর্ণতা দান, কার্যকর ও অর্থবহ করার জন্য শারীরিক শিক্ষা অন্যতম পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। ইউরোপের পুনর্জাগরণেরও (রেনেসাঁ) আগে শিক্ষা নিয়মকানুনের শৃঙ্খলে বাঁধা ছিল। এসময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক শিক্ষা বলতে আলাদা কিছু ছিল না। সামরিক শক্তির অনুষঙ্গ হিসেবে শারীরিক শিক্ষাকে বিবেচনা করা হতো। রাষ্ট্রের নাগরিককে রাষ্ট্রের বৃহত্তর কল্যাণে গড়ে তোলার প্রয়োজনে শিক্ষাক্ষেত্রে আমূল সংস্কার সাধিত হয়। শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ ও সবল জাতি গঠনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শিক্ষা কর্মসূচির প্রচলন হয়। নানা রূপ পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োগ প্রভৃতি স্তর পার হয়ে আধুনিক শারীরিক শিক্ষার জন্ম হয় ইউরোপে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এর উপযোগিতা প্রমাণিত হওয়ায় পরবর্তীকালে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে ইউরোপের শারীরিক শিক্ষার পদ্ধতি ও কর্মসূচি সীমিত আকারে চালু হয়। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পরে তৎকালীন পাকিস্তানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শারীরিক শিক্ষা কর্মসূচি চালু হয়। সে সময়ের সরকার প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক শিক্ষার জন্য শিক্ষক নিয়োগ, খেলার মাঠ, ক্রীড়াসরঞ্জাম, আন্তঃমাদ্রাসা, আন্তঃকলেজ, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের প্রচলন শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে শারীরিক শিক্ষাকর্মসূচি বজায় থাকে ।
বাংলাদেশে শারীরিক শিক্ষার ব্যবস্থাপনা ও কর্মসূচি ভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। প্রশাসনিকভাবে যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রণালয় শারীরিক শিক্ষার ব্যবস্থাপনা দায়িত্ব পালন করে। এর অধীনে ক্রীড়া অধিদপ্তর দেশের ৬টি সরকারি শারীরিক শিক্ষা কলেজের প্রশাসনিক ও প্রশিক্ষণ বিষয়ক কর্মসূচির তদারকি করে থাকে। এসব কলেজ থেকে প্রশিক্ষণ লাভ করে শিক্ষকগণ দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শারীরিক শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। এসব শারীরিক শিক্ষার শিক্ষকের মাধ্যমে শারীরিক শিক্ষাকর্মসূচির বাস্তবায়ন তথা খেলাধুলার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এছাড়া ক্রীড়া অধিদপ্তরের অধীনে কর্মরত জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা সরকার কর্তৃক গৃহীত ক্রীড়া কর্মসূচি বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে থাকে অন্যদিকে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের আওতাধীন শিক্ষা অধিদপ্তরে শারীরিক শিক্ষা বিভাগে বছরে দুইবার জাতীয় স্কুল ও মাদ্রাসা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এছাড়া তাদের ব্যবস্থাপনায় শারীরিক শিক্ষা শিক্ষকদের রিফ্রেশার্স কোর্স নিয়মিত পরিচালিত হয়। শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব বিবেচনায় সরকার ‘শারীরিক শিক্ষা ও স্বাস্থ্য' বিষয়টিকে ৬ষ্ঠ-৮ম শ্রেণি এবং ‘শারীরিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান ও খেলাধুলা' বিষয়টিকে ৯ম-১০ম শ্রেণিতে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এজন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তক প্রণীত হয়েছে। এবতেদায়ী স্তরে শিক্ষকরা শারীরিক শিক্ষার নির্দেশিকার মাধ্যমে শিশুদের শারীরিক শিক্ষা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা ও জ্ঞানদান করে।
মাদ্রাসা পর্যায়ে বয়সভিত্তিক প্রতিযোগিতা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শারীরিক শিক্ষাকর্মসূচিকে আরও কার্যকর ও বেগবান করা হয়েছে। সামাজিকভাবে বাংলাদেশে শারীরিক শিক্ষার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতীয় জীবনে এর আশু সুফল দৃশ্যমান হবে বলে আশা করা যায়।
কাজ-১: | বাংলাদেশের শারীরিক শিক্ষা সম্বন্ধে তোমার ধারণা বর্ণনা কর। |
কাজ-২: | বাংলাদেশে শারীরিক শিক্ষার উপরে যে যে কার্যক্রম আছে তা লেখ । |
Read more